কুমিল্লা প্রতিনিধি
আগের দুই বারের পরাজয়ের স্মৃতি ভুলে তৃতীয়বার এতে বাজিমাত করল ক্ষমতাসীন দল। কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী আরফানুল হক রিফাত হারিয়ে দিলেন দুই বারের মেয়র মনিরুল হক সাক্কুকে।
কেবল সিটি করপোরেশন নয়, এর আগে পৌরসভা নির্বাচনেও জয় পেয়েছিলেন এবার ভোটে নেমে বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত নেতা। তার রাজনৈতিক জীবনে এটি প্রথম পরাজয়।
নৌকা নিয়ে রিফাত ভোট পেয়েছেন ৫০ হাজার ৩১০ টি, ঘড়ি প্রতীকে সাক্কুর পক্ষে রায় দিয়েছেন ৪৯ হাজার ৯৬৭ জন। ভোটের ব্যবধান ৩৪৩টি।
সাক্কুর এই পরাজয়ে প্রধান ভূমিকায় ছিলেন স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা নিজামউদ্দিন কায়সার, যিনি ভোট করতে দলের পদ ছাড়েন। তার ভোটে লড়ার প্রধান কারণ সাক্কু ঠেকাও বলে ধারণা করা হয়।
কায়সারের ঘোড়া প্রতীকে ভোট পড়ে ২৯ হাজার ৯৯ টি।
এই নির্বাচনে মেয়র পদে আরও দুই জন প্রার্থী ছিলেন। তারা কেউ আলোচনায় ছিলেন না, ভোটাররাও সেভাবে তাদের পক্ষে সমর্থন দেননি।
এই দুই প্রার্থীর মধ্যে ইসলামী আন্দোলনের রাশেদুল ইসলাম হাত পাখা প্রতীক নিয়ে পেয়েছেন ৩ হাজার ৪০ ভোট। আর দল নিরপেক্ষ কামরুল আহসান বাবুল হরিণ প্রতীক নিয়ে পেয়েছেন ২ হাজার ৩২৯ ভোট।
দিনভর ভোটকে ভালো বললেও ফলাফল ঘোষণার পর সাক্কু ভোট প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি দাবি করেন, তার জয় ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে।
ঘরের শত্রু’ নিজামউদ্দিন কায়সার এই নির্বাচনে সাক্কুর জীবনের প্রথম পরাজয়ের কারণ হতে পারে বলে শুরু থেকেই আলোচনা হচ্ছিল। বলা হচ্ছিল, স্বেচ্ছাসেবক দল থেকে পদত্যাগ করে কায়সারের ভোটে দাঁড়ানোর ‘আসল লক্ষ্য’ ছিল ‘সাক্কু ঠেকাও’।
২০১২ সালে সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচনে সাক্কু জেতেন ৩৫ হাজার ভোটে। হারান আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা আফজল খানকে।
২০১৭ সালের নির্বাচনে সাক্কু হারান আফজল কন্যা আঞ্জুম সুলতানা সীমাকে। জয়ের ব্যবধান কমে আসে ১১ হাজারে।
এবার বিএনপি ভোজ বর্জন করায় সাক্কু লড়েন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে। দলীয় সিদ্ধান্ত না মানায় তাকে হারাতে হয় দলীয় পদও।
ওদিকে সাক্কুর বিরোধী অংশের ভরসায় ভোটে দাঁড়ান স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা নিজামউদ্দিন কায়দার।
কুমিল্লা মহানগরে বিএনপি দৃশ্যত দুই ভাগে বিভক্ত। এক অংশের নেতৃত্ব দেন সাক্কু, আর তার প্রতিদ্বন্দ্বী সাবেক সংসদ সদস্য আমিনুর রশীদ ইয়াসিন। এই ইয়াসিনের শ্যালক হলেন কায়সার।
সাক্কু ও ইয়াসিনের বিরোধ কুমিল্লার মানুষজনের কাছে খুবই পরিচিত ইস্যু। দুই নেতার দ্বন্দ্বের কারণে দলীয় সভা আলাদা স্থানে হয়ে আসছে সেখানে।
কেন্দ্রীয়ভাবে কোনো কর্মসূচির ডাক দেয়া হলে সাক্কুর অনুসারীরা দক্ষিণ জেলা বিএনপি অফিসে অবস্থা নেন। অন্যদিকে ইয়াসিন সমর্থকরা একত্রিত হন ধর্মসাগর পাড়ে তার ব্যক্তিগত কার্যালয়ে।
কায়সার কত ভোট কাটবেন, শুরু থেকেই সেই আলোচনা ছিল। প্রাথমিক ফলাফলে দেখা যাচ্ছে নৌকার তুলনায় সাক্কু ও কায়সারের সম্মিলিত ভোট অনেকটাই বেশি।
বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে প্রথম ভোটের যে পরীক্ষা হচ্ছে বিভিন্ন এলাকায়, তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি চোখ কুমিল্লাতেই।
সকাল ৮টা থেকে শুরু হওয়া ভোট শেষ পর্যন্ত হয়েছে শান্তিপূর্ণ। প্রথমবারের মতো কোনো ভোটে সব কেন্দ্রে বসানো হয় সিসিটিভি ক্যামেরা। এই ভোটে বলার মতো কোনো সহিংসতা বা অভিযোগ উঠেনি। এমনকি প্রার্থীরাও তেমন কোনো অভিযোগ করেননি।
তবে একটি কেন্দ্রে গোপন কক্ষে বাইরের মানুষের উপস্থিতি এবং একটিতে গোপন কক্ষে পোলিং কর্মকর্তার উঁকি দেয়ার বিষয়টি গণমাধ্যমে এসেছে।
ইভিএমে নেয়া এই ভোটে ধীরগতি নিয়েই শুরু থেকে ছিল আলোচনা। ভোটারদের অনভ্যস্ততা ছাড়াও কোথাও কোথাও মেশিনে ত্রুটির কারণে বেগ পেতে হয়।
বেলা ৪টায় ভোট শেষ হওয়ার কথা থাকলেও কোনো কোনো কেন্দ্রে ভোট চলেছে ৫টা পর্যন্ত।
পৌনে ছয়টার দিকে রিটার্নিং কর্মকর্তা একে একে ফল ঘোষণা করতে থাকেন।
সব কিছু যখন শান্তিপূর্ণভাবে চলছিল, রাত আটটার পর হঠাৎ দেখা দেয় উত্তেজনা। ৭২ কেন্দ্রের ফল ঘোষণার পর শিল্পকলা অ্যাকাডেমিতে দলে দলে আসতে থাকে আওয়ামী লীগ ও সাক্কুর সমর্থকরা। দুই পক্ষ সেখানে পাল্টাপাল্টি স্লোগান দিতে থাকে।
সে সময় ফল ঘোষণায় বেগ পেতে হয় অনেকটাই। পরে রিটার্নিং কর্মকর্তা যখন চূড়ান্ত ফল ঘোষণা করেন,তখন বাইরে নৌকার সমর্থকরা উল্লাসে ফেটে পড়েন আর সাক্কু সমর্থকরা প্রতিবাদ জানাতে থাকেন।
এর আগে ফল ঘোষণা শুরুর আগে রিটার্নিং কর্মকর্তা শাহেদুন্নবী চৌধুরী বলেন, বৃষ্টির কারণে প্রিজাইডিং অফিসারের আসতে সময় লাগছে।